পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-৬)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২৩ নভেম্বর, ২০১৪, ০৯:০৫:০৬ সকাল
মিথিলা বাবু!
আমার বাবা একদিন সকালে- শীতের সকাল ছিল সেটা - আজ এই এতোদিন পরে স্মৃতিগুলোও কুয়াশাচ্ছন্ন অনুভূতিতে কেমন ঝাপসা মনে হচ্ছে। তবুও মনে পড়ছে আমি, আমার ছোট ভাই মা-বাবার হাত ধরে আমাদের টিনের দোতলা বাড়িটা ছেড়ে বের হয়ে এসেছি। দুই চাচা তাদের ঘরের ভিতর থেকে ক্ষোভে বেরও হলেন না। চাচীরা অবশ্য কাঁদছিলেন। আর দাদী? তিনি পাথরের মত নির্বাক হয়ে ঘরের দরোজায় অটল দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার ভিতরে কি ভাবের আদান-প্রদান চলছিল? তখন বুঝিনি কিছু। আজ অনেকটা অনুভব করতে পারছি।
খালের পারে এসে দেখি নৌকা তৈরী। সেখানে আমাদের সাথের মালামাল নিয়ে আমাদের দূর সম্পর্কের চাচা মেরাফ অপেক্ষা করছেন।
আমাদেরকে দেখে স্বভাবসুলভ হাসি হাসলেন। হাসিতে বিষন্নতা।
মায়ের চোখ অশ্রুসজল। মাফলারে আর কানটুপিতে আবৃত বাবাকে দেখেও দাদীর মত ভাবহীন অটল পাথরের কথা সেই শিশু বয়সে মনে হয়েছিল।
আমাদেরকেও কান টুপীতে ঢেকে বাবা হাত ধরে নৌকায় তুলেছিলেন।
নৌকা ছেড়ে দিল।
এর আগে মনে হচ্ছিল আমরা বাবার সাথে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি। কিন্তু এই যাওয়া যে আমাদের এক নতুন জীবনের জন্য যাওয়া, সেটা নৌকা ছাড়ার সময় বাবা ও মেরাফ চাচার কথায় বুঝতে পারি।
আমার চোখের সামনে দিয়ে আমার পরিচিত গাছপালা, সেই খালের পার, পার থেকে নুয়ে বাঁকা সেই হিজল গাছটি, যার তলায় ছাবি দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরতাম, কত স্মৃতি!
বড় হয়ে বিভূতিভূষনের লিখা পথের পাচালি পড়েছিলাম। সেখানে অপুর বোন দুর্গা মারা যাবার পরে অপু যখন গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছিল, তখন অপুর চোখে যে দৃশ্যগুলো ধরা পরেছিল তা পড়তে পড়তে আমার সেই দিনটা, সেই দিন দেখা সব কিছু, সেদিনের শোনা সব শব্দ মনে পড়ছিল। অপুকে মনে হচ্ছিল আমি। আম আঁটির ভেঁপু 'র মত, রেলের হুইসেলের মত বেজে ওঠা লঞ্চের সেই ঘাট ছেড়ে যাবার বাঁশীর শব্দে ব্যথাভরা মনে তোলপাড় করেছিল শুধু একটা প্রশ্ন, ' আর কি ফিরবো ? '
নদীর কিনারের সাথে গ্রামটা যখন ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছিল সেই সময়ে আমার শিশু মনে গুমরে কাঁদছিলো বড়দের বিরুদ্ধে নিস্ফল - নি:শব্দ অভিযোগ। ' কেন ওরা কেউ কারো সাথে একটু ভালো হয়ে থাকতে পারলো না? ' হু হু কান্নায় বুক ভেংগে যাচ্ছিলো। নিরবে চোখের পানি বয়ে যাচ্ছিলো নদীর চেয়ে তুমুল স্রোতে। মূহুর্তে মূহুর্তে ভেসে উঠছিল প্রিয় মুখগুলি, আমার চিরপরিচিত গ্রাম, প্রতিদিনের খেলার সাথীরা, সরু খাল, খালের উপর সাঁকো, খেলার যায়গাগুলো, প্রিয় পথঘাট, স্কুল, দোকানপাট । যা কিছুই চোখে পড়ছিলো তাকেই মন বলছিলো, 'বিদায় বন্ধু! আবার দেখা হবে '। কিছু দেখছিলাম চোখে। কিছু দেখছিলাম মনে মনে। যা কিছুই মনে পড়ছিলো তাকেই মন বলছিলো, 'বিদায় বন্ধু! বড় হয়ে ফিরে আসবো! '
ছেড়ে যাবার সেই অসীম ব্যথা বহুদিন বুকে টনটন করে উঠেছে। ফিরে যাবার সেই আশাও রয়ে গিয়েছিল অনেক বছর। কতদিন বুকে হাত রেখে ভেবেছি, 'বড় হই! বড় হয়ে যখন ফিরবো, কেউ আমাদেরকে কিছুতেই গ্রাম থেকে বের করে দিতে পারবে না। '
সেই পুরনো স্মৃতি! আমাদের নৌকা যখন ছাড়ে বৈঠার ওঠা নামার তালে তাল মিলিয়ে ছলকে ছলকে উঠতে নামতে থাকা পানির সাথে ছোট্ট বুকটাতে ছলকে উঠছিলো অচেনা কষ্ট। নদীর পাড় বেয়ে মাঝির গুণ টেনে যাওয়া দেখে মনে হচ্ছিলো, সে যেন টেনে টেনে আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! যখন লঞ্চে উঠলাম, লঞ্চ ঘাট ছেড়ে যাবার সময় মেরাফ চাচা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে মনে হচ্ছিল আমার হৃদয়ে কিছু একটা যেন ভাঙ্গাচুরা হচ্ছে। আম আঁটির ভেঁপু 'র মত, রেলের হুইসেলের মত বেজে ওঠা লঞ্চের ঘাট ছেড়ে যাবার বাঁশীর শব্দে ব্যথাভরা মনে তোলপাড় করেছিল শুধু একটা প্রশ্ন, ' আর কি ফিরবো ? '
শুধু কি একটা গ্রাম ছেড়ে এসেছিলাম সেদিন ? সে তো ছিলো নিজের জীবনের সাথে বিচ্ছেদ ।
সেদিনের আগে নদীটাকে দেখলেই কতদিন ভেবেছি, 'জানতে পারতাম - এই নদী কোথায় যায়! ' জানার দিন যেদিন এলো সেদিন সেই নদীকে মনে হলো শত্রু। মনে হলো, ' কেন নদী এতদূরে বইলো? নইলে কি এই লঞ্চটা এভাবে আমাদেরকে সবার কাছ থেকে এত দূরে নিয়ে যেতে পারতো? ' আজ হাসি। যার যেতেই হতো, নদী হোক না হোক, তাকে তো পথ খুঁজে নিতেই হতো।
গ্রাম থেকে বাবা আমাদেরকে নিয়ে খুলনা শহরে খালিশপুর নামক যায়গায় একটা এক রুমের ভাড়া বাসায় উঠলেন।
বাবা একটা স্কুলে জব ঠিক করে আমাদেরকে নিয়ে এসেছেন। তাই আপাতত আমাদের তেমন সমস্যা হল না নতুন যায়গায় এসেও। আমি তখন ক্লাশ টুতে পড়ি। শহরে আব্বা আমাকে থ্রীতে ভর্তি করে দিলেন।
এই নতুন যায়গায় পাশের ভাড়াটিয়ারা ছিলো আমাদের জন্য শহরের প্রতিনিধি। আমরা তাদের কাছে গ্রাম। কেন যেন কেউই কাউকে পছন্দ করতে পারলাম না।
লম্বা এল শেপ টিনের সেমিপাকা বাড়ি। আরো তিনটি পরিবার ছিল।
গ্রাম থেকে নতুন আসা পরিবারটা যেন আগে থেকে শহরে বাস করা পরিবার দুটোর এলাকায় এসে অনধিকার চর্চা করে ফেললো। আমাদের জামা কাপড়, পরার ধরণ ধারণ, ভাষা, খাওয়া দাওয়া, স্বভাব, অভাব সব কিছুই যেন আমাদেরকে ব্যঙ্গ করছিলো।
বিকালে মহিলারা ঘরের সামনের জায়গাটায় অলস গল্পে বসলে মা হয়তো গিয়ে তাদের সাথে বসতেন। মহিলারা একে অন্যের চোখে চোখে ইশারা করতেন। আমার চোখে পড়লে কষ্ট হতো। কিছু করতে পারতাম না। রাগ করে আম্মাকে কতবার নিষেধ করেছি ওদের কাছে যেতে। আম্মাও কতবার আমাকে খেলতে যেতে নিষেধ করেছে। মানুষতো পানির মত। পাশাপাশি এলে কিছু না কিছু মিশে যাবেই। অভিযোগে অনুযোগে হলেও মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক থেকেই যায়।
আমাদের ভাড়া বাসার সামনের একটি দোতলা বাড়িতে রুপা নামের এক মেয়ে ছিল। ওদের পরিবার ওই এলাকায় অনেক প্রভাবশালী ছিল। ওর এক ভাই নাম ছিল মুন্না। আমার বয়সী।
রুপা আমার থেকে ছোট ছিল।
কিন্তু কিভাবে যেন ওর সাথে আমার প্রথম দেখায় এক বিকেলবেলা বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
মুন্নার সাথে অন্য ছেলেদেরকে নিয়ে বিকেলে খেলার সময়ে টেনিশ বল ড্রেনে পড়ে গেলে, মুন্না আমাকেই তুলে আনতে বলত।
কারণ আমি ছিলাম সবাই যারা বিকেলে খেলতে আসত, তাদের ভিতরে গরীব ঘরের ছেলে।
আমার বাবা শিক্ষক মানুষ এবং আমরা এক রুমের একটি ভাড়া বাসায় থাকি।
তাই আমি-ই নোঙরা ড্রেন থেকে প্রতিবার বল তুলে আনতাম।
রুপার এগুলো ভালো লাগত না।
সে একদিন ভাইকে বলে, 'তুমি কেন বার বার ওকে বল উঠাতে বল?"
আমাকে বলল ,' তুমি আর উঠাবে না।'
গ্রামে চেয়ারম্যানদের থেকে পেয়েছিলাম প্রথম দফায়। শহরে এসেও শ্রেণীবৈষম্য আমার মনে দ্বিতীয় দফায় দাগা দিয়ে গেল। কী ছেড়ে এলাম! কেন সব ছেড়ে এই অচেনা শহরে এলাম? গ্রামের চেয়ে শহর কিসে আলাদা হলো? শহুরে সমাজের শ্রেনী বিভেদ আমাকে হতাশ করলো।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১০৫২ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কত প্রয়োজনে,নতুন আয়োজনে ছেড়ে যেতে হয় আপন জায়গা,আপন জন,আপন পরিবেশ!
সহ্য করতে হয় কত বিরুপ পরিবেশ!
এরই নাম জীবন!এরই নাম বেঁচে থাকা!!
বর্ণনার অসাধারণ নান্দনিকতা 'পটভূমি'কে জীবন্ত আবয়বে হাজির করেছে পাঠকের সামনে!
'সেই পুরনো স্মৃতি' .........।
হ্যা, এরই নাম জীবন, এভাবেই বেঁচে থাকতে হয়, বেঁচে আছি আমরা।
হৃদয়ের গভীর থেকে অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
একটু পড়ে পড়তে আসবো ইনশাআল্লাহ।
সাথে রইলেন এবং অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
শুভেচ্ছা রইলো।
ভাইয়া, প্লিজ ২ দিন সময় দেন, সম্পুর্ণটি পড়েই ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।
খুব দাগ কাটলো অন্তরে।
তাই আমি-ই নোঙরা ড্রেন থেকে প্রতিবার বল তুলে আনতাম।
এটা গরীব সমাজের প্রতিচ্ছবি..
তবে আমরা এ কাজটা করতাম রুটিন মাফিক এখন ও তখন ও।
খুব ভালো লাগলো ভাইয়া।
অনেক ধন্যবাদ
খুব সুন্দর করে আপনার অনুভূতিগুলো জানালেন, অনেক ভালো লাগলো।
শুভকামনা রইলো আপনার জন্য।
বারাকাল্লাহু ফিকুম।
ভালো লাগা রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ভালো থাকুন।
শুভকামনা রইলো।
আপনার মন্তব্যে অভিভূত হলাম! ভালো লাগা রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
বারাকাল্লাহু ফীকুম।
সাথে রইলেন, সুন্দর মন্তব্য করলেন, ভালো লাগার অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন